আজ ১লা বৈশাখ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রাণের উচ্ছ্বাস

Published On Apr 14, 2022


বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিনে ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রায় পা মিলিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় টিএসসির রাজু ভাস্কর্য প্রাঙ্গণ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বের হয়। এই শোভাযাত্রা স্মৃতি চিরন্তন হয়ে আবারও টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়েছে।

করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। ২০২১ সালে হয়েছে সীমিত পরিসরে, যেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না।

আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয়ও স্থান পেয়েছে এবারের শোভাযাত্রায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন।

ইউনেস্কো ঘোষিত ‘মানবতার স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত মঙ্গল শোভাযাত্রার এবারের স্লোগান হচ্ছে- ‘নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’।

শোভাযাত্রায় যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ব্যাপক সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রাখা হয়েছে পুরো এলাকা।

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ কবিগুরু এভাবেই পুরনো গ্লানি মুছে দিয়ে নতুন বছরে নতুন উদ্দীপ্ততায় এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সব না পাওয়া, ব্যর্থতা, ব্যথা-বেদনা ও হাহাকারকে বিদায় জানিয়ে সাফল্য ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। বিদায়ী বছরের সব ব্যর্থতা ভুলে নতুন বছরে এগিয়ে যাওয়ার দীপ্ত প্রত্যয়ের প্রথম দিন আজ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। আজ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দ ১৪২৯-এর প্রথম দিন। পাওয়া-না পাওয়ার জীবনের হালখাতার সব হিসাব চুকে দিয়ে, ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আজ বাংলা নববর্ষে নতুনভাবে এগিয়ে যাবে বাঙালি। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল পৃথক বাণীতে বাঙালির মহামলিনের এই দিনে দেশবাসীর সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতি কামনা করেছেন। বিদায়ী বছরের সব ব্যর্থতা পেছনে ফেলে জাতি আজ উদ্দীপ্ত হবে নতুন শপথে। রবিঠাকুরের অমিয় সুরের মূর্ছনা ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটির মধ্য দিয়ে আজ দেশব্যাপী বৈশাখকে স্বাগত জানাবে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ মেতে উঠবে বৈশাখী ভালোলাগায়। তবে মাহে রমজান উপলক্ষে এবারের উদ্যাপনে অতটা জৌলুশ থাকবে না মনে করছেন রাজধানীর বাসিন্দারা। পান্তা-ইলিশ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা আর মন্ডা-মিঠাই দিয়ে জাতি আজ বৈশাখী ভালোবাসা বিনিময় করবে। তবে রমজানের কারণে সব আয়োজনের ব্যাপ্তিই থাকবে সীমিত। ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে পয়লা বৈশাখকে স্বাগত জানাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। ছায়ানট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, চ্যানেল আই ও সুরের ধারা, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে নতুন বছর বরণ করবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা, নাচ-গান, আবৃত্তিসহ থাকছে নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন। সকাল সোয়া ৬টায় রমনার বটমূলে ঐতিহাসিক প্রভাতি আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে রাজধানীর বর্ষবরণের আয়োজন। ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে ঐতিহ্যবাহী ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানাবে। সাড়ে ৯টায় চারুকলা অনুষদ থেকে বের হবে অনুষদের শিক্ষার্থীদের তৈরি অনুষঙ্গ দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হয়ে ফের চারুকলায় এসে শেষ হবে। এ ছাড়া রবীন্দ্রসরোবার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিল্পকলা একাডেমিসহ গোটা রাজধানীতেই থাকবে বৈশাখের নানা আয়োজন। গতকাল চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়েছে সারা দেশ।

আজ সরকারি ছুটি। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক একে পৌরাণিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে আজ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জাতীয় দৈনিকগুলোয় ক্রোড়পত্র প্রকাশ হবে। বাংলা নববর্ষে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার ও ইফতারের আয়োজন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষ ১৪২৯ উপলক্ষে গতকাল দেওয়া বাণীতে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতা ভুলে সবাইকে নব-আনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, বাঙালির মহামিলনের দিন। এদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে, নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতা ভুলে সবাইকে আজ নব-আনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানাই।’

বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্ক র‌্যাব-পুলিশসহ আইন প্রয়োকারী সংস্থাগুলো। নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে রাজধানীসহ সারা দেশের অনুষ্ঠানস্থলগুলোর দিকে রয়েছে তাদের বিশেষ নজরদারি। এসব স্থান এরই মধ্যে সিসিটিভির আওতায় নেওয়া হয়েছে। নেওয়া হয়েছে সাত স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা দুই দিন ডগ স্কোয়াড ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানস্থলগুলো দফায় দফায় সুইপিং করা হয়েছে। আজকের জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখা হয়েছে বোম্ব ডিসপোজাল টিম, ডগ স্কোয়াড, র‍্যাবের হেলিকপ্টার, স্পেশাল কমান্ডো ফোর্স, অতিরিক্ত প্যাট্রল টিম, মেডিকেল টিম, ভেহিকল স্ক্যানার। স্থাপন করা হয়েছে অতিরিক্ত চেকপোস্ট, অবজারভেশন পোস্ট। রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রবীন্দ্রসরোবরে পুলিশ-র‍্যাবের স্থাপিত সাব কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে মনিটরিং করা হবে নিরাপত্তা আয়োজন।

গতকাল রমনা বটমূলে নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে র‍্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ‘বর্ষবরণ অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে জঙ্গি হামলার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি না। গোয়েন্দা নজরদারি ও সাইবার জগতে মনিটরিং বাড়ানোর মাধ্যমে জঙ্গিদের যে কোনো ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে প্রস্তুত রয়েছে র‍্যাব। প্রস্তুত থাকবে র‍্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম।’ নিরাপত্তা প্রস্তুতি সম্পর্কে র‍্যাব ডিজি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে দেশব্যাপী  র‍্যাব বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। নববর্ষ কেন্দ্র করে ভার্চুয়াল জগতে যাতে কোনো উসকানিমূলক বা মিথ্যা তথ্য ছড়াতে না পারে সেজন্য র‍্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে। ২৪ ঘণ্টা তারা দায়িত্বে নিয়োজিত।’ জানা গেছে, সার্বক্ষণিকভাবে আজকের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে র‍্যাব হেলিকপ্টার। রমনার পাশের এলাকায় সব যানবাহন বন্ধ থাকবে। প্রস্তুত রাখা হচ্ছে বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াত, ডগ স্কোয়াডের পাশাপাশি রমনার লেকে থাকবে নৌ-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। দুই দিন ধরেই পোশাকে-সাদা পোশাকে র‍্যাব-পুলিশের সদস্যসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন অনুষ্ঠানস্থলসহ বিভিন্ন এলাকায়। নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় বসানো হয়েছে অতিরিক্ত চেকপোস্ট। সুউচ্চ ভবনগুলোর দিকে রাখা হয়েছে বিশেষ দৃষ্টি। অনুষ্ঠানস্থলগুলোর আশপাশে অস্থায়ী ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করে সার্বক্ষনিক পরখ করা হচ্ছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। ইভ টিজিং প্রতিরোধে সাদা পোশাকে থাকবে পুলিশের বিশেষ টিম। শোভাযাত্রা ও অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করতে হলে প্রত্যেককে তল্লাশির আওতায় আনা হবে। ছায়ানটের সমন্বয়ক লাইসা আহমেদ লিসা গত সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আয়োজনে আমরা সন্তুষ্ট। বৃহস্পতিবার (আজ) সকাল সোয়া ৬টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে সাড়ে ৮টায় শেষ হবে। আজও (বুধবার) আমরা বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত রিহার্সাল করেছি।’